বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন মূলভাব
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখক
বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন মূলভাব পরিচিতি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে জুন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । বাংলা ভাষায় প্রথম শিল্পসম্মত উপন্যাস রচনার কৃতিত্ব তাঁরই । তাঁর পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর । ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রথম স্নাতকদের মধ্যে তিনি একজন । পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট ।
এ চাকরিসূত্রে খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করে তিনি নীলকরদের অত্যাচার দমন করেছিলেন । দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান ; যোগ্য বিচারক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল । বাংলা সাহিত্যচর্চায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন তিনি ।
উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনার বাইরে বঙ্গদর্শন ( ১৮৭২ ) পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ তাঁর অন্যতম কীর্তি । ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে ‘ সম্বাদ প্রভাকর পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু ।
বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থসংখ্যা ৩৪। তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস ‘ দুর্গেশনন্দিনী ‘ । তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো : ‘ কপালকুণ্ডলা মৃণালিনী বিষবৃক্ষ কৃষ্ণকান্তের উইল চন্দ্রশেখর আনন্দমঠ দেবী চৌধুরাণী রাজসিংহ সীতারাম । Rajmohons Wife নামে একটি ইংরেজি উপন্যাসও তিনি রচনা করেছেন ।
বঙ্কিমচন্দ্র ধর্ম দর্শন সাহিত্য ভাষা ও সমাজবিষয়ক অনেক প্রবন্ধ রচনা করেছেন । লোকরহস্য বিজ্ঞানরহস্য কমলাকান্তের দপ্তর সাম্য কৃষ্ণচরিত্র বিবিধ প্রবন্ধ ইত্যাদি তাঁর গদ্যগ্রন্থ । বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি সাহিত্যসম্রাট উপাধিতে ভূষিত হন ।বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ই এপ্রিল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন ।
১। যশের জন্য লিখিবেন না । তাহা হইলে যশও হইবে না লেখাও ভালো হইবে না । লেখা ভালো হইলে যশ আপনি আসিবে । ২। টাকার জন্য লিখিবেন না । ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে এবং টাকাও পায় লেখাও ভালো হয় ।
কিন্তু আমাদের এখনও সে দিন হয় নাই । এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে , লোকরঞ্জন – প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে । এখন আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লোকরঞ্জন করিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে ।
৩ যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন , তবে অবশ্য লিখিবেন ।
যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন , তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে ।
৪। যাহা অসত্য ধর্মবিরুদ্ধ পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য সে সকল প্রবন্ধ কখনও হিতকর হইতে পারে না সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য । সত্য ও ধর্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য । অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী – ধারণ মহাপাপ ।
৫। যাহা লিখিবেন , তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না । কিছু কাল ফেলিয়া রাখিবেন । কিছু কাল পরে উহা সংশোধন করিবেন । তাহা হইলে দেখিবেন , প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে । কাব্য নাটক উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া
রাখিয়া তারপর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে । যাঁহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্যে ব্রতী , তাঁহাদের পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া উঠে না । এজন্য সাময়িক সাহিত্য , লেখকের পক্ষে অবনতিকর ।
৬। যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই সে বিষয়ে তাহার হস্তক্ষেপ অকর্তব্য । এটি সোজা কথা কিন্তু সাময়িক সাহিত্যতে এ নিয়মটি রক্ষিত হয় না ।
Also my link…..
অতিথির স্মৃতি সৃজনশীল প্রশ্ন উত্তর
৭। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করিবেন না ।বিদ্যা থাকিলে তাহা আপনিই প্রকাশ পায় , চেষ্টা করিতে হয় না । বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা পাঠকের অতিশয় বিরক্তিকর এবং রচনার পরিপাট্যের বিশেষ হানিজনক । এখনকার প্রবন্ধে ইংরাজি সংস্কৃত ফরাসি জার্মান কোটেশন বড় বেশি দেখিতে পাই । যে ভাষা আপনি জানেন না , পরের গ্রন্থের সাহায্যে সে ভাষা হইতে কদাচ উদ্ধৃত করিবেন না ।
৮। অলংকার প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টিত হইবেন না ।
স্থানে স্থানে অলংকার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে লেখকের ভাণ্ডারে এ সামগ্রী থাকিলে প্রয়োজন মতে আপনিই আসিয়া পৌঁছিবে- ভাণ্ডারে না থাকিলে মাথা কুটিলেও আসিবে না । অসময়ে বা শূন্য ভাণ্ডারে অলংকার প্রয়োগের বা রসিকতার চেষ্টার মতো কদর্য আর কিছুই নাই ।
৯। যে স্থানে অলংকার বা ব্যঙ্গ বড় সুন্দর বলিয়া বোধ হইবে সেই স্থানটি কাটিয়া দিবে এটি প্রাচীন বিধি 1 আমি সে কথা বলি না । কিন্তু আমার পরামর্শ এই যে সে স্থানটি বন্ধুবৰ্গকে পুনঃ পুনঃ পড়িয়া শুনাইবে । যদি ভালো না হইয়া থাকে তবে দুই চারি বার পড়িলে লেখকের নিজেরই আর উহা ভালো লাগিবে না – বন্ধুবর্গের নিকট পড়িতে লজ্জা করিবে । তখন উহা কাটিয়া দিবে ।
১০। সকল অলংকারের শ্রেষ্ঠ অলংকার সরলতা । যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাইতে পারেন তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক । কেন না লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে বুঝানো ।
১১। কাহারও অনুকরণ করিও না । অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত হয় গুণগুলি হয় না । অমুক ইংরাজি বা সংস্কৃত বা বাঙ্গালা লেখক এইরূপ লিখিয়াছেন আমিও এরূপ লিখিব এ কথা কদাপি মনে স্থান দিও না ।
১২। যে কথার প্রমাণ দিতে পারিবে না তাহা লিখিও না । প্রমাণগুলি সংযুক্ত করা সকল সময়ে প্রয়োজন হয় না কিন্তু হাতে থাকা চাই ।
১৩। বাঙ্গালা সাহিত্য বাঙ্গালার ভরসা । এই নিয়মগুলি বাঙ্গালার লেখকদিগের দ্বারা রক্ষিত হইলে বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে থাকিবে । শব্দার্থ ও টীকা যশ লোকরঞ্জন ধর্মবিরুদ্ধ কোটেশন সুখ্যাতি সুনাম কীর্তি । জনসাধারণের মনোরঞ্জন বা সন্তোষবিধান । নীতি – নৈতিকতার বিরোধী । উদ্ধৃতি । অন্যের লেখা থেকে বক্তব্য উদ্ধার করে অপর লেখায় ব্যবহার ।
বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন
অলংকার -ভূষণ , প্রসাধন , শোভা । ভাষার মাধুর্য ও উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে এমন গুণ
ব্যঙ্গ -পরিহাস , বিদ্রুপ
কদাপি-কখনও , কোনোকালে ।
বাঙ্গালা – বাংলা । উনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্রের কালে ‘ বাংলা’কে ‘ বাঙ্গালা ‘ বলে লেখা হতো । শব্দটির পরিবর্তন হয়েছে এভাবে : বাঙ্গালা – বাঙলা – বাংলা ।
পাঠ – পরিচিতি
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উনিশ শতকীয় বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে পরিচিত । “ বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন ” রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ প্রচার ‘ পত্রিকায় , ১৮৮৫ সালে ; পরে এটি তাঁর ‘ বিবিধ প্রবন্ধ ‘ নামক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয় । সাধু রীতিতে লেখা এই প্রবন্ধটি আকারে ছোট হলেও চিন্তার মৌলিকত্বে অসাধারণ । বক্তব্যের তাৎপর্য বিচার করলে প্রবন্ধটির রয়েছে সর্বকালীন বৈশ্বিক আবেদন ।
নতুন লেখকদের প্রতি তিনি যে পরামর্শ এখানে উপস্থাপন করেছেন তার প্রতিটি বক্তব্যই পালনযোগ্য । খ্যাতি বা অর্থের উদ্দেশ্যে লেখা নয় ; লিখতে হবে মানুষের কল্যাণ সাধন কিংবা সৌন্দর্য সৃষ্টির অভিপ্রায়ে ।
বঙ্কিমচন্দ্রের মতে , অসত্য , নীতি – নৈতিকতা বিরোধী কিংবা পরনিন্দার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা স্বার্থতাড়িত লেখা পরিহার করা বাঞ্ছনীয় । তিনি বলতে চান , নতুন লেখকরা কিছু লিখে তাৎক্ষণিকভাবে না ছাপিয়ে কিছুদিন অপেক্ষা করে পুনরায় পাঠ করলে লেখাটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে । যার যে বিষয়ে অধিকার নেই সে বিষয়ে লেখার চেষ্টা করা যেমন অনুচিত তেমনি লেখায় বিদ্যা জাহির করার প্রবণতাকেও তিনি নিন্দনীয় বলে মনে করেছেন ।
অনুকরণবৃত্তিকেও দূষণীয় বলেছেন । অনাবশ্যকভাবে লেখার সৌষ্ঠব বৃদ্ধি বা পরিহাস করার চেষ্টাও তাঁর কাছে কাম্য নয় । সারল্যকেই তিনি সকল অলংকারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অলংকার বলে মনে করেছেন । সর্বোপরি বস্তুনিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ।
এভাবে এই ছোট লেখাটিতে তিনি লেখকের আদর্শ কী হওয়া উচিত তা অত্যাবশ্যকীয় শব্দ প্রয়োগে উপস্থাপন করেছেন । নবীন লেখকরা বঙ্কিমচন্দ্রের পরামর্শ মান্য করলে লেখক ও পাঠক সমাজ নিশ্চিতভাবে উপকৃত হবেন ; আমাদের মননশীল ও সৃজনশীল জগৎ সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হবে বহুনির্বাচনি
প্রশ্ন ১। লেখকের লোকরঞ্জন – প্রবৃত্তি ‘ প্রবল হয়ে ওঠে কী কারণে ?
প্রশ্ন- যশের জন্য লিখলে কী হয় ?
লেখার উদ্দ্যেশ্য যদি যশ খ্যাতি অর্জন
করা হয় যশ পালিয়ে যাবে বহুদূরে ধরা দেবে না, কিছুতেই।
ক . পাঠকের রুচি বিবেচনায় আনলে
খ . অর্থলাভের আশায় লিখলে
গ . সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য থাকলে
ঘ . বিদ্যা প্রকাশের প্রচেষ্টা থাকলে
২। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘ লেখা ‘ বিলম্বে ছাপাতে বলেছেন কেন ?
ক . উপযুক্ত প্রমাণ সংযোজনের সুবিধার্থে
খ . পাঠকের মনে চাহিদার উদ্রেক করতে
গ . লেখার ভুল – ত্রুটি সংশোধন করতে ফর্মা –
ঘ .মনুষ্য৩ , সাহিত্যপাঠ একাদশ , দ্বাদশ ও আলিম শ্রেণি ১৭জাতির মঙ্গল সাধন করতে
সৃজনশীল প্রশ্ন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় বিশ্বব্যাপী মূল্যবোধের অবক্ষয় , অর্থনৈতিক বিপর্যয় , হতাশা ও হাহাকারে উপমহাদেশের জীবন ছিল নানা অভিঘাতে বিপর্যস্ত ও রূপান্তরিত । এমনই এক পরিবেশে কাজী নজরুল ইসলাম ( ১৮৯৯-১৯৭৬ ) তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতায় বিনির্মাণ করলেন শাশ্বত কল্যাণ ও সাম্যবাদের মহাকাব্যিক এক আশাবাদী জগৎ তিনি কলম তুলে নিলেন শোষণ- বঞ্চনাহীন শ্রেণিবৈষম্যহীন ক্ষুধা – দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক এক জগৎ সৃষ্টি করতে ।
মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সাম্যের গান গাইলেন । এক সময় তিনি হয়ে উঠলেন ধর্মবর্ণ শ্রেণি গোত্র নির্বিশেষে সকল সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের কলমসৈনিক । শোষণ বঞ্চনা ও সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ আজও আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে বারংবার ।
ক . বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে সাহিত্যের উদ্দেশ্য কী ?
খ . অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী – ধারণ মহাপাপ- বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন ?
গ .উদ্দীপকের কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য সাধনা বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন প্রবন্ধের কোন বৈশিষ্ট্যটির প্রতিফলন ঘটায় ব্যাখ্যা কর ।
ঘ . বাংলার নতুন লেখকদের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নিবেদন উদ্দীপকে যথার্থভাবে প্রকাশিত হয়েছে কি ? উদ্দীপক ও প্রবন্ধের আলোকে তোমার মতামত দাও ।